রিযিকের স্বচ্ছলতা বা সংকীর্ণতা এক রহস্যঘেরা বিষয়। অনেকেই মনে করেন, রিযিক হচ্ছে অর্থকড়ি ও বিপুল ধন-ঐশ্বর্য। কিন্তু, সঠিক হলো রিযিক একটি ব্যাপক পরিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সুস্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা, সময় ও জীবনের বরকত, সন্তান-সন্ততি ও তাদের সুস্থতা এবং সার্বিক কল্যাণ-উন্নতি। আর এ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণই কেবল আল্লাহর হাতে। মহান রাবুল আলামিন তার সমগ্র সৃষ্টিকূলকে রিযিক দান করেন, তাই তিনি তার মহান গুণবাচক একটি নামও ধারণ করেছেন আর-রাজ্জাক। আর তিনিই সমস্ত রিযিকের উৎস এবং একমাত্র রিযিকদাতা- এ বিশ্বাস আমাদের আকিদার অংশ।
রিযিক বৃদ্ধি পাক, জীবনে স্বচ্ছলতা আসুক, অন্তত প্রয়োজন পরিমাণ রিযিক আমার থাকুক- এ কামনা সবার। তবে ব্যক্তিভেদে সবার নিয়্যত এক নয়। বহু মানুষ- যারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়ার জন্য রিযিক কামনা করেন, এ লেখা তাদের জন্য নয়। এ লেখা তাদের জন্য যারা প্রশান্তচিত্তে এক আল্লাহতে সমর্পিত হয়ে থাকতে প্রয়োজন পরিমাণ হালাল রিযিক কামনা করেন।
রিযিকে স্বচ্ছলতা কামনার পেছনে একজন মুসলমানের যে নিয়ত থাকতে পারে— তার নিয়ত হতে পারে তার উপর তার পরিবারের আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ও অধিকারগুলো আদায় করা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বিশ্বের অপরাপর মুসলমানদের ও বিশেষত আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মেহনতে সাহায্য করা। বেশি বেশি দান-খয়রাত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রজন করা এবং সর্বোপরি ইসলামী সমাজকে সর্বোচ্চে তুলে ধরা। আসলে একজন মুসলমানের সম্পদ উপার্জন ও রিযিক কামনার নেপথ্যে এমন নিয়্যতই থাকা উচিত এবং তার ব্যয়ও হওয়া উচিত এসব বৃহৎ স্বার্থেই। নিম্নে রিযিক বাড়ানোর ৬টি ঐশী উপায় বিবৃত করা হলো—
১. তাকওয়া- মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের সুরা তালাকে এরশাদ করেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে পরিত্রাণের পথ করে দেবেন এবং এমন উৎস থেকে তাকে রিযিক দান করবেন, যার কল্পনাও সে করেনি। যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করে দিবেন।’ (সুরা তালাক: ২-৩)
এ আয়াত কুরআনের এমন এক আয়াত, যাতে আল্লাহ মুমিন বান্দার সাথে তাকওয়া অর্জনের ভিত্তিতে বিশেষভাবে তাকে সাহায্য করার ও তার বিশেষ উৎস থেকে তাকে রিযিক প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। আর আল্লাহ তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এ সত্য সাহাবাদের জীবন ইতিহাস থেকে এ যাবৎকালের বহু বিশ্বাসী খোদা ভীরু বান্দার জীবনে প্রমাণিত। কাজেই বিপদে এবং কষ্টের সময় তাকওয়াকে অবলম্বন বানানো রিযিক লাভের প্রধানতম মাধ্যম এবং তা রিযিক লাভের এক নম্বর শর্তও বটে।
২. তাওয়াক্কুল- ‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’ (সুরা তালাক: ৩)
উপরের আয়াতটিই আবার উল্লেখ করা হলো। উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা আয়াতের প্রথম অংশটি খেয়াল করি, আলোচনায় বলি। কিন্তু, দ্বিতীয় অংশটি ভুলে যাই। প্রথম অংশে রয়েছে তাকওয়ার কথা আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে ‘তাওয়াক্কুল’ এর কথা।
তাওয়াক্কুল মানে হচ্ছে কোনো কিছু হাসিল করার উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করা। একই সাথে এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ যা আমার জন্য কল্যাণকর তাই আমাকে দিবেন। জীবনের কঠিনতম সময়ে এই তাওয়াক্কুল মানুষকে শান্তি দেয়, ধীরস্থির এবং সৎ রাখে। আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা স্থাপন করলে অসম্ভব স্থান থেকে রিযিক লাভ করা যায়।
৩. দান-সদকা করা-‘এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সঙ্কুচিত করেন অতঃপর তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তারই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।’ (সুরা বাকারাহ- ২৪৫)
আমরা আল্লাহর পথে বেশি বেশি দান সদকা করব, গরীব-অসহায়দের সাহায্য করব। এতে দুটো লাভ। প্রথম লাভ হলো অন্তরের শান্তি এবং দ্বিতীয় লাভ রিযিক বৃদ্ধি। দানকে আল্লাহ তাআলা ১০ গুণ থেকে শুরু করে আরও বেশি বৃদ্ধি করে থাকেন। আপনি যে সকল নেককার মুসলমানেরই রিযিকের প্রাচুর্য দেখতে পাবেন, খুঁজে দেখবেন তাদের সবারই বেশি বেশি দানের অভ্যাস রয়েছে। সাহাবাদের জীবনেও বিষয়টি প্রমাণিত। তাই তাকওয়া এবং তাওয়াক্কুলের সাথে যদি বেশি বেশি দান-সদকা করা হয় তাহলে আপনার রিযিক এমনভাবে বাড়বে যা আপনি কখনো কল্পনাও করেননি।
৪. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ও শোকরগুজার হওয়া- ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা ইব্রাহীম-৭)
রিযিক বৃদ্ধির চতুর্থ উপায় হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি অনেক বেশি শোকরগুজার হওয়া। বর্তমানে আমার যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা এবং ক্রমাগত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে যাওয়া। আমার চোখে যা ছোট হতে পারে তা অন্যজনের কাছে অনেক বড়। কাজেই কোনোভাবেই আল্লাহর না অকৃতজ্ঞ হওয়া যাবে না। কারণ, কৃতজ্ঞতা রিযিককে বাড়িয়ে দেয় এবং অকৃতজ্ঞতা রিযিককে ধ্বংস করে। আপনার ওপর অনুগ্রহগুলো ভালভাবে চিন্তা করুন এবং প্রতিদিন নিয়মিতভাবে করে এর শুকরিয়া আদায় করুন। ইনশাআল্লাহ রিযিক বাড়বেই।
৫. তওবা এবং ইস্তেগফার – ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অবিরাম বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান তৈরি করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা নুহ: ১০-১২)
পঞ্চম উপায়টা গ্রহণ করা হয়েছে নূহ আলাইহিসসালাম এর উপদেশ থেকে, যা তিনি তার জাতিকে দিয়েছিলেন। তিনি তার জাতিকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যদি তারা তওবা ইস্তেগফার করে তাহলে মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের রিযিক অনেক বাড়িয়ে দিবেন। উপরের আয়াতে বৃষ্টি, সন্তান-সন্তুতি, নদী-নালা ও বাগান ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে, যা রিযিকের ব্যাপক মাধ্যম। পঞ্চম পয়েন্ট অত্যন্ত সহজ। আমরা সবাই প্রতিদিন অনেক গুণাহ করে ফেলি। অতএব আমাদের উচিত বেশি বেশি করে ইস্তেগফার করা, প্রতিদিন তওবা করা। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিনে ১ শতবার তওবা করতেন। আমরাও যদি বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করি তাহলে আলাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইনশাআল্লাহ আমাদের রিযিক বেড়ে যাবে বহুগুণ।
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা-সহীহ বুখারিতে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে চায় যে তার রিযিক বাড়ুক এবং তার হায়াত বাড়ুক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।’ রিযিক বাড়ার ষষ্ঠ উপায় হচ্ছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং টিকিয়ে রাখা। এমন অনেক আত্মীয় থাকবে যাদের সাথে কোনো কারণে কোনো এক সময় সম্পর্ক খারাপ হয়েছে এবং এখনো খারাপ আছে। উচিত হবে আপনি নিজেই এগিয়ে যান। তাদের সাথে মেলামেশা শুরু করুন, সম্পর্কটি পুনরায় জীবিত করুন। আপনার আত্মীয় স্বজন যদি কখনো আপনার সাথে কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে ক্ষমা করে দিন। এভাবে যখন আমরা আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখব এবং বাঁচিয়ে রাখব, তখন আল্লাহ যেমন ওয়াদা করেছেন, আমাদের রিযিক অভাবনীয় উৎস থেকে বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।
শেষ কথা- সবকিছুর পর মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়া হচ্ছে আমাদের জন্য পরীক্ষার জায়গা। রিযিক বেশি পেয়ে তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিতে ব্যয় না করা হয় তাহলে সে রিযিকের মূল্য কি? বরং যত বেশি রিযিক তত বেশি পুনরুত্থান দিবসে কঠিন হিসাব-নিকাশের বিপদ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে হাশরের ময়দানে আমাদের পূর্ণ হায়াত, সমুদয় সম্পদ, সমস্ত নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। যাদের বেশি দেয়া হয়েছে তাদের হিসাব হবে বেশি, সময় হবে বড়। কাজেই এ বিষয়টা আমাদেরকে অবশ্যই চিন্তায় রাখতে হবে।